আমরা যারা আশির দশকের গোড়ার দিকে জন্মেছি অথবা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মেছেন, তাদের উভয়েই একটা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। আর তা হচ্ছে ১৯৯০’র স্বৈরশাসনের পতনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালা পরিবর্তনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যা আমাদের মনন ও মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে গ্রোথিত হয়ে আছে।
দশ বছর বয়সী এক কিশোরের চোখে আমি সেই সময়টি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম চট্টগ্রামের রাস্তায় প্রতিবাদমুখর জনতার মিছিল, অনুভব করেছিলাম আসন্ন সামগ্রিক সম্ভাবনার সোনালি ভোর। মনে হচ্ছিল আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি নতুন ভোরের সাক্ষী হতে যাচ্ছি। তখন আমি অভ্যাসগতভাবে যে কাজগুলো করতাম তার মধ্যে একটি হলো আমার বাংলা শব্দভান্ডার উন্নত করার জন্য সংবাদপত্র পড়া, সেই সংবাদপত্রের পাতায়ই প্রথমবারের মতো বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে আমার প্রথম জানা। সেই পত্রিকার পাতায়ই আমার চোখ নিবদ্ধ হয়েছিল সাধারণ সাদা শাড়ি পরা একজন নারীর ছবির প্রতি, যার মুখাবয়ব ছিল দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, যিনি হ্যান্ডমাইকে উৎসুক জনতার প্রতি বক্তব্য রাখছিলেন। সেই প্রতিচ্ছবি এখনো আমার মনে খোদাই করা আছে।
পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা আমাকে ছবিটির ব্যক্তি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন যে তিনি কোন সাধারণ মহিলা নন, তিনি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম-এর পত্নী এবং চলমান স্বৈরাচার এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রধান নেত্রী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপার্সন । এই বিষয়ে দুটি মৌলিক তথ্য আমাকে কৌতূহলী করেছিল এবং ছোটবেলায় আমার উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল।
প্রথম বিষয়টি ছিল যে একজন নারী এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর পূর্ব কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না যা তাঁকে এমন একটি বিশাল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে সহায়তা করতে পারে। পুরুষ শাসিত এমন একটি সমাজে সহস্র বাধা ডিঙ্গিয়ে যিনি এক দশক ধরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছিলেন, বাংলাদেশের ভাগ্যকে সুনিশ্চিত করেছিলেন ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করেছিলেন, তিনি কোন সাধারণ নারী নন। তিনি অবশ্যই কোন সাধারণ নারী ছিলেন না, তিনি আমাদের ত্রাণকর্তা ছিলেন। আমি সবসময় তাকে এভাবেই দেখেছি এবং এখনও সেইভাবেই জানি।
আমার উৎসুক কিশোর মন তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। অনুসন্ধানে আমি জেনেছিলাম কীভাবে তিনি একটি রাজনৈতিক দল যেটি ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে, তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সেই দলটিকে এক বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত করেছিলেন যা আশির দশকে দীর্ঘ নয় বছর রাজপথে জনপদে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করেছিল। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর তিনি তৃণমূল থেকে বিএনপিকে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিনি জনসমর্থন তৈরি করতে এবং উপযুক্ত প্রার্থীদের খুঁজে বের করার জন্য সারা দেশে সফর করেছিলেন। তাঁর একক জনপ্রিয়তাই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী করে এবং দলটিকে বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি একজন আপসহীন নেত্রী হিসাবে ক্রমাগ্রত নিজেকে নিজে অতিক্রম করেছিলেন। শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যদি বিএনপির আদর্শিক মেরুদণ্ড হন তাহলে বেগম খালেদা জিয়াই তৈরি করে ছিলেন দলের সাংগঠনিক ভিত্তি।
১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে সার্কিট হাউজে দূর থেকে তাকে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার মনে আছে। তার সেই মুখ তখনও সেই পত্রিকার পাতায় আমার দেখা সেই দৃঢ় সংকল্পকে উদ্ভাসিত করছিল যিনি সকল প্রতিকূলতাকে পরাজিত করে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এই কৃতিত্ব, এই অর্জন কেউ তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবেন না।
আমার বাবা ১৯৯১ সালে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হন, এরপর রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে দীর্ঘ সময় বেগম খালেদা জিয়াকে পর্যবেক্ষণ করলেও, আমার উপর ছোটবেলায় ব্যক্তি বেগম জিয়ার সেই প্রভাবই স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া নিজে উদাহরণ তৈরি করেছেন যে আমাদের সমাজের মহিলারা দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। এটি আমাকে আমাদের সমাজে মহিলাদের কাজের সম্ভাবনা ও গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন ইতিবাচক ভাবনায় উপনিত করেছিল।
এখন তিন দশক পরে এসে আমরা ১৯৯০-এর মতো একই দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছি। আমরা এখন এমন একটি শাসনব্যবস্থায় রয়েছি যেখানে বিরোধীমত ও মানুষ কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছেন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অনুপস্থিত এবং ক্ষমতায় তাদের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। ১৯৯০ এর এর বিপরীতে, এখন অসুস্থ খালেদা জিয়া তাঁর জীবনের জন্য লড়াই করছেন যখন সরকার তাঁর সর্বোত্তম চিকিৎসায় বাধা দিয়ে চলেছে। কিন্তু এটা লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে গত কয়েক বছরে তার প্রতি ঘটা সরকারি হিংসাত্নক আচরণ ও কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও, তিনি এখনও সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অসীম ধৈর্য এবং আপসহীনতার প্রতীক হয়ে সারা জাতিকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন । একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে বিগত এক দশক ধরে নিশ্চিহ্ন করার যে অপচেষ্টা চলেছে তার বিপরীতে দলটি যে টিকে আছে, তা বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব এবং ধৈর্যেরই প্রমাণ। এইভাবে, একজন অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনার জন আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত প্রতীক হয়ে আছেন এখনো।
আমার জন্য, আমার মধ্যে থাকা কিশোরটি এখনও বিশ্বাস করে যে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে আমাদের পরিত্রাতা হিসেবে, পথপ্রদর্শক হিসাবে আমাদের কাছে ফিরে আসবেন। তাঁর অদম্য জীবন ও পথচলা আমাদের জন্য আদর্শ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও আদর্শ হয়ে থাকবে। সুস্থ হয়ে উঠুন বেগম খালেদা জিয়া, আপনার জনগণ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং লড়াই কিন্তু শেষ হয়নি।
লেখক :: একজন উদ্যোক্তা।