ফেনী ও নোয়াখালীর মতো পাশের জেলা লক্ষ্মীপুরেও বিএনপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে না আসা এবং ২০১৮ সালে ভরাডুবির পর কিছুটা হালে পানি পায় আওয়ামী লীগ। কোথাও কোথাও আবার মহাজোট থেকে শরিক দলগুলোর প্রার্থী দিয়ে বৈতরণী পার হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। রামগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত লক্ষ্মীপুর-১ আসনে মহাজোট থেকে তরিকত ফেডারেশনের এম এ আউয়াল বিএনপির বাইরে প্রথমবার জয়ী হন দশম সংসদ নির্বাচনে। একাদশে নৌকা প্রতীকে জয়ী হন আনোয়ার খান। ২০ দলের প্রার্থী এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে হারান তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই দলেরই গলার কাঁটা এখন অন্তর্কোন্দল।
সরেজমিনে এই সংসদীয় আসন ঘুরে ও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রামগঞ্জজুড়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলের নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কোন্দল চরমে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ সিনিয়র নেতাদের মুখে ঐক্য থাকলেও কাজে নেই। আর বিভক্ত বিএনপির জোটগত মনোনয়ন অংকে ‘আতঙ্ক’ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম।
এই আসনের বর্তমান এমপি ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান। তিনি রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। এমপি থেকেও দল গোছাতে পারেননি তিনি।
তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক। প্রকাশ্যে-গোপনে সিনিয়র শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ চরমে। যার ছোঁয়া আছে তৃণমূল পর্যায়েও।
প্রবাসে থাকা উপজেলা ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আনোয়ার খানের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে হামলা-মামলা দিয়ে তাকে অনেক পুলিশি হয়রানি করা হয়েছে। আরও অনেক নেতাকর্মীকে তিনি এলাকাছাড়া করেছেন। অন্য নেতার ফেসবুক পোস্টে লাইক, কমেন্টস করলেও বিপদে পড়তে হয়।
ভাটরা, লামচর, ইছাপুর ও ভোলাকাট ইউনিয়নের তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর অভিযোগ, আনোয়ার খান আওয়ামী লীগকে সংঘটিত না করে বিভক্ত করেছেন। দলীয় পদ ও স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে তিনি গত ইউপি নির্বাচনে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে কাজ করেছেন পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে। দলের বিদ্রোহীদের মদত ও টাকা দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগও সবার জানা। দলীয় বিরোধ সমাধানে তার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
কেউ কেউ আনোয়ার খানের প্রশংসাও করেছেন। এলাকার মানুষকে সময় দেন এবং তিনি ভালো মানুষ বলে মনে করেন তারা।
লামচর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মাহফুজ আলম পাটোয়ারী বলেন, আনোয়ার খান আসার পর এখানে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে। এটি বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা হলেও তাদের সক্রিয় কোনো অবস্থান নেই। তারা প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠান করতে পারছে না।
সদ্য বিলুপ্ত রামগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মিলন আটিয়া বলেন, রামগঞ্জে দলীয় কমিটিগুলো নিয়মিত হচ্ছে না। এতে সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের তৎপরতা থাকলে দল চাঙার পাশাপাশি বিরোধী জোটও ভয়ে থাকে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান পবন বলেন, রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের আলাদা কোনো অবস্থান তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে দলের প্রতি মানুষের ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তবে এখানে না আছে আওয়ামী লীগ, না আছে যুবলীগ, না আছে ছাত্রলীগ। সাংগঠনিক কোনো কাঠামো নেই। এ কারণে নেত্রী যাকেই দলীয় মনোনয়ন দেবেন, তার পক্ষে নির্বাচন করাটা কঠিন হবে। এমপি শুধু নিজের বলয় সৃষ্টি করেছেন।
হাবিবুর রহমান পবনের ভাষ্যমতে, রামগঞ্জে ইউপি নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থীর বদলে এমপি নিজের প্রার্থী দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যাকে দলীয় মনোনয়ন দেন, সেটা যদি তার (এমপি) মনোমতো না হয়, তখন এমপির পছন্দের প্রার্থীকে মাঠে নামান। রামগঞ্জে তিনি কেন্দ্রে যাদের একক নাম পাঠিয়ে নৌকা এনে দিয়েছেন সবার কিন্তু পরাজয় হয়েছে। আগামীতে নির্বাচন করতে হলে কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করতে হবে। পোলিং এজেন্ট এখন থেকে নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু এসবে তার কোনো উদ্যোগ নেই। পরিবেশ যদি না থাকে দলীয় অনেক নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রে যাবেন না।
রামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মনির চৌধুরী বলেন, আপনারা তো সবই জানেন। আমরা কোনো কথা বলে তো লাভ নেই। আর এসব বলার দরকার কী?
তবে পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদসহ তিনজন নেতা দাবি করেন, এমপি এলাকায় সময় দেন। তিনি এলাকায় এলে ব্যস্ত সময় পার করেন। সরকারি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি দলীয় সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন। অর্থনৈতিক সহায়তাও দিচ্ছেন।
বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করে আনোয়ার হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সাংগঠনিক অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। ভোটের মাঠেও ভালো অবস্থান। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দলের জন্য কাজ করছি। আগামী নির্বাচনে এ আসনে নৌকা বিজয়ী হবে।
বিএনপিতেও প্রকাশ্যে বিরোধ :
আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিতেও প্রকাশ্যে বিরোধ চলছে। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বলে অভিযোগ তুলছে। তারা প্রকাশ্যে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে না থাকলেও সম্প্রতি পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, সম্মেলন ছাড়াই ২৯ অক্টোবর গভীর রাতে ফেসবুকে রামগঞ্জ উপজেলা ও পৌর বিএনপি কমিটি ঘোষণা করেন জেলার নেতারা। এতে উপজেলা কমিটিতে নাজিম উদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক ও শেখ মাহবুবুর রহমান বাহারকে সদস্য সচিব মনোনীত করা হয়। পৌরসভা কমিটিতে শেখ মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব করা হয় আলমগীর হোসেন মিয়াকে। এতে কিছু নেতাকর্মী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা নতুন কমিটির নেতাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। তাদের একটি অংশ অভিযোগ তোলে, বিএনপির উপজেলা ও পৌরসভা কমিটিতে পরিকল্পিতভাবে এলডিপির নেতাদের রাখা হয়েছে। এটি বিএনপির জন্য অশনিসংকেত।
এর জেরে গত ৪ নভেম্বর রাতে এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমের রামগঞ্জের করপাড়ার বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া ৭ নভেম্বর রামগঞ্জ উপজেলা ও পৌর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন নেতাকর্মীরা। এতে খোদ সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক নাজিম উদ্দিন আহমেদসহ নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। অন্য পক্ষের বিএনপি নেতারা এলডিপি নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তারা সেলিমের হয়ে মাঠে কাজ করছেন।
নাজিম উদ্দিনের দাবি, এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিমের লোকজনকে বিএনপির কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা কখনো বিএনপি করেনি। নেতাকর্মীরা এটি মেনে নিচ্ছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিএনপি নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে রামগঞ্জে প্রকাশ্যে নেতাকর্মীরা একটি মিছিলও করতে পারেননি। রাস্তায় নামারও চেষ্টা করেননি। কিন্তু নিজেরা বিবাদে জড়িয়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার শেল্টার নিয়ে দুপক্ষ এখন পাল্টাপাল্টি সভা, সংবাদ সম্মেলন করছে। খালেদা জিয়ার জন্য তারা পারেন না অথচ নিজেরা শক্তির মহড়া দিচ্ছেন।
উপজেলা বিএনপির মধ্যম সারির দুই নেতা জানান, জোটগত কারণে এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
রামগঞ্জে বিএনপির গ্রুপিং সম্পর্কে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও দলের প্রচার সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে মান-অভিমান থাকবে। দলের বৃহৎ স্বার্থে নতুন কমিটির নেতাদের এক হয়ে কাজ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগির তাদের অভিমান কেটে যাবে।
এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শামছুল আলম বলেন, বিএনপির পক্ষে মানুষের জনসমর্থন আছে। কিন্তু এখানে যারা ভোট করবে তারা বিভক্ত। এখন অনেক নেতা বের হচ্ছেন লন্ডন পার্টির। তারা তো মধু পার্টি।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী যারা :
আসনটি থেকে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খান। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক এম এ মমিন পাটোয়ারী, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাবিবুর রহমান পবন ও রামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবুল খায়ের পাটোয়ারী মনোনয়নপ্রত্যাশী।
বিএনপি থেকে আসনটির সাবেক সংসদ সদস্য ও রামগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাজিম উদ্দিন আহমেদ, জোটগত কারণে এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংসদের (জাসাস) সাবেক সভাপতি মামুনুর রশিদসহ একাধিক নেতা মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানা যায়।
এছাড়া এ আসনে জাতীয় পার্টির নেতা মাহমুদুর রহমান মাহমুদ ও শাহাদাত হোসেন বাবুল দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে তাদের অনুসারীরা প্রচার করছেন।