তৃণমূলের বিদায়ী চার রাজ্যসভা সাংসদের তিন জনকেই প্রার্থিতালিকায় রাখলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বদলে যে তিন জনকে আনলেন, প্রত্যেকেই মহিলা। সুস্মিতা দেব আগেও রাজ্যসভায় গিয়েছেন তৃণমূলের হয়ে। কিন্তু বাকি দু’জন নতুন। মমতাবালা ঠাকুর লোকসভায় ছিলেন আগে। রাজ্যসভার পথে প্রথম। এবং সাগরিকা ঘোষ সব দিক থেকে নতুন মুখ তো বটেই, তালিকায় সবচেয়ে বড় চমকও।
মমতার রাজনীতিতে মহিলাদের গুরুত্ব দেওয়া নতুন কিছু নয়। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটে যে অনুপাতে মহিলা প্রার্থী রাখেন তিনি, দেশে তা বিরল। তবে রাজ্যসভায় তৃণমূলের মহিলা সাংসদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম ছিল। লোকসভায় তৃণমূলের সাংসদদের ৪২ শতাংশ মহিলা। বিধানসভায় তৃণমূল সদস্যদের ৩৩ শতাংশের বেশি মহিলা। সেখানে বর্তমান রাজ্যসভায় তৃণমূলের ১৩ জনের মধ্যে মাত্র দু’জন মহিলা। দোলা সেন ও মৌসম বেনজির নুর। সেই সংখ্যাই এ বার এক ধাক্কায় পাঁচে চলে যাবে, সব কিছু হিসাব মতো চললে।
বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিত্বেই শুধুমাত্র মহিলাদের গুরুত্ব দেওয়া নয়, বর্তমান এবং আগামী দিনের মহিলা ভোটারদের দিকেও বিশেষ নজর দিয়ে থাকেন রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পরই কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প ঘোষণা করেন তিনি। রাজ্যে শেষ বিধানসভা ভোটের আগে তাঁর ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প অনেকের কাছেই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে স্বীকৃত। মমতার পথে একই প্রকল্প নিয়ে বিজেপিও নির্বাচনী ফসল তুলেছে মধ্যপ্রদেশে। গত বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বাংলার যে বাজেট পেশ হল, তাতে লক্ষ্মীর ভান্ডারের অর্থ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতার সরকার।
তৃণমূলের চার বিদায়ী সাংসদের মধ্যে একমাত্র যাঁকে রাজ্যসভায় রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মমতা নিলেন, তিনি নাদিমুল হক। দলের অবাঙালি সংখ্যালঘু মুখ। রাজ্যসভায় এই নিয়ে তৃতীয় বারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক উর্দু দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদক নাদিমুল ২০১২ সাল থেকে তৃণমূলে হয়ে রাজ্যসভায় রয়েছেন। এত দিন শাসকদলের সাংসদ হলেও, তাঁকে নিয়ে কখনওই কোনও বির্তক দেখা দেয়নি। যা নিয়ে তাঁর উপর প্রসন্ন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব। সঙ্গে যখন তাঁকে যে দায়িত্বই দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্ব নীরবেই পালন করেছেন তিনি। প্রথম হজ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর কাজ সমাদৃত হয়েছে মুসলিম সমাজে। বর্তমানে তিনি পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান। শনিবার থেকে দিল্লিতে শুরু হয়েছে বইমেলা। সেই বইমেলায় মমতার লেখা বইগুলির উর্দু অনুবাদ বিক্রি হচ্ছে নাদিমুলের উদ্যোগেই।
মমতাবালা ঠাকুর মহিলা মুখ তো বটেই, একই সঙ্গে মতুয়া মুখও বটে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি মমতাবালা ২০১৫ সালে বনগাঁ লোকসভার উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রতীকে জয়ী হয়ে সাংসদ হন। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বনগাঁয় মমতাবালার স্বামী কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রয়াত হন কপিলকৃষ্ণ। তাঁর প্রয়াণে শূন্য হওয়া আসনে জয়ী হন মমতাবালা। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে প্রয়াত বীণাপানি দেবীর ছোট নাতি এবং বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুরের কাছে পরাজিত হন তিনি। গত বিধানসভা ভোটেও মতুয়া ভোটের সিংহভাগ বিজেপির পক্ষে গিয়েছে। এ অবস্থায়, আগামী লোকসভা ভোটে হারানো ভোট পুনরুদ্ধার তৃণমূলের লক্ষ্য। সে দিক থেকে মমতাবালাকে রাজ্যসভায় পাঠানো সুবিধাজনক হবে বলেই মনে করেছেন দলনেত্রী মমতা।
তৃণমূলের রাজ্যসভায় প্রার্থিতালিকায় আর এক মহিলা মুখ সাগরিকা। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। প্রবাসী বাঙালি সাগরিকা বড় হয়েছেন দিল্লিতে। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের লেখাপড়া শেষ করে রোডস্ স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান বিলেতে। ইংল্যান্ডের অক্সফর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় উচ্চশিক্ষা। দেশে ফিরে সাংবাদিকতা শুরু করেন। জাতীয় স্তরের বহু সংবাদ সংস্থায় সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন। নিয়মিত লেখালেখি করেন। লিখেছেন দেশের দুই প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে টিভিতে প্রশ্ন-উত্তরের বিশেষ অনুষ্ঠান করেছেন সাগরিকা। তাঁর স্বামী রাজদীপ সরদেসাইও সাংবাদিক।
সুস্মিতা দেবের তৃণমূলে আগমন ২০২১ সালের অগস্ট মাসে। কংগ্রেসের মহিলা সংগঠনের সভানেত্রীর পদ ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের পুরস্কার পান কয়েক মাসের মধ্যেই। বিধানসভা ভোটে জিতে মন্ত্রী হওয়া মানস ভুঁইয়া রাজ্যসভার সাংসদ পদ ছাড়লে সুস্মিতাকে সংসদের উচ্চকক্ষে পাঠায় তৃণমূল। রাজ্যসভায় পাঠানোর পাশাপাশি, ত্রিপুরা ও অসমের সংগঠন দেখভালের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে। ত্রিপুরাতে সফল না-হলেও, রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে নিজের অল্প সময়েই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন এই মহিলা নেত্রী। তবে তৃণমূলে গুঞ্জন ছিল, যোগদানের শর্ত হিসেবে তাঁকে শিলচর থেকে প্রার্থী করার কথাও তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন সুস্মিতা। ত্রিপুরা বিধানসভায় তৃণমূলের খারাপ ফলাফলের পর, ২০২৩ সালের রাজ্যসভায় তাঁর মেয়াদ শেষ হলে সুস্মিতাকে আর প্রার্থী করেনি তৃণমূল। কিন্তু লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে আবারও প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সন্তোষ মোহন দেবের কন্যাকে রাজ্যসভায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন মমতা।
এ বারের রাজ্যসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের মোট ৫টি আসনে ভোট হচ্ছে। তারই চারটি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে তৃণমূল। একটি আসনে প্রার্থী দেবে বিধানসভার প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। প্রত্যেক প্রার্থীকে ৪৯টি করে ভোট পেতে হবে। যদি এই নির্বাচনে পাঁচজনের বেশি প্রার্থী হলে তবেই ভোট হবে। তৃণমূল ও বিজেপি কোনওপক্ষই অতিরিক্ত প্রার্থী দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচজনের প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।