স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার তথ্যমতে ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যানের প্রায় ২৫ ভাগ শিশু-কিশোর। চিত্রটি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে প্রায় একই রকম। চট্টগ্রামে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে পুরুষ ৫০.৮ শতাংশ, নারী ২৩.২৪ শতাংশ এবং শিশু ২৫.৯৪ শতাংশ।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় ও হাসপাতালের চিকিৎসকদের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের মধ্যে শিশু আক্রান্তের হার ২৬ শতাংশ হলেও মোট মৃত্যুহারে শিশু ৫০ শতাংশ। ডেঙ্গুতে ২০২৩ সালে এত শিশু আক্রান্ত ও মৃত্যু হওয়ার উদ্বেগজনক।
শিশুদের আক্রান্তের সঠিক কারণ জানতে পারলে এর প্রতিকার করা সম্ভব। একজন কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘ গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি শিশুদের মশা কামড়ানোর ঝুঁকি বেশি।
স্ত্রী মশার পেটে যখন ডিম আসে তখন তার প্রধান খাদ্য রক্ত এবং শিশুরা প্রায়শই এই মশার শিকার হয়। মশা কামড়ালে, শিশুর ত্বকে কামড় সঙ্গে সঙ্গে দেখা নাও যেতে পারে, তবে কিছুক্ষণ পরে বা কয়েক ঘণ্টা পরেও কামড়ের চুলকানি এবং ফোলাভাব হয়।
অনেকগুলো কারণে শিশুদের মশা কামড়ানোর হার বেশি।
বাচ্চাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্রুত বিপাক হয়, বেশি নড়াচড়া এবং দৌড়াদৌড়ি করার কারণে ব্যায়াম হয় এবং তাপমাত্রা বেড়ে ঘাম হয় ও দেহ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যায়। মশা কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে শিশুদের কামড়াতে যায়। শিশুরা বেশি নড়াচড়া করার কারণে মশার জন্য আরও দৃশ্যমান এবং আকর্ষণীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের ত্বকের তুলনায় শিশুদের ত্বক নরম এবং কামড়ের জন্য বেশি সংবেদনশীল। নরম ত্বকে সহজেই মশা তার হুল ফুটিয়ে রক্ত গ্রহণ করতে পারে। শিশুরা মশার কামড়কে সহজে বুঝতে পারে না এবং মশা তাড়াতে পারে না। শিশুরা গাঢ় পোশাক পরে; শিশুদের ত্বকে প্রাকৃতিকভাবে অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে; শিশুরা ছায়ায় খেলতে ভালোবাসে—যেখানে মশা লুকিয়ে থাকে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর কারণে মশার কামড় ও মশাবাহিত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি শিশুদের বেশি। এছাড়া, মশা কামড়ালে শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দুর্বল হয়, তাই তারা রোগের জন্য বেশি সংবেদনশীল।
ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি। দেখা যাচ্ছে, শিশুরা চিকিৎসার আওতায় আসছে দেরিতে। স্বাভাবিক জ্বর মনে করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেরিতে করা হচ্ছে। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনার কারণে অনেকে মারা যাচ্ছে। তাই এই সময়ে অভিভাবকদের ডেঙ্গু নিয়ে অতিমাত্রায় সচেতন থাকা উচিত। অভিভাবকরা অবহেলা করলে চলবে না। শিশুর মৃত্যুর হারে দেখা যাচ্ছে, চারজনের মধ্যে তিনজনই ভর্তির দু-এক দিনের মধ্যে মারা যায়।
শিশুর মৃত্যুর হার বেশি হবার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিশুরা ডেঙ্গু রোগের লক্ষণগুলো বুঝতে বা বলতে পারেন। শরীরে রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমতে শুরু করে। হঠাৎ করে ডেঙ্গুর শকে চলে যায়। যদি প্রথম দিকে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের সমস্যা হয় না। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসার আওতায় আসতে দেরি হলে শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। ওই সময় জরুরি চিকিৎসা করলেও বাঁচানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তিনটা রক্তের গ্রুপের মধ্যে O (পজিটিভ, নেগেটিভ) গ্রুপের রক্তের ব্যক্তিদের মশার কামড়ের সম্ভাবনা বেশি। দুঃখজনকভাবে, এই পরিস্থিতির কোনো প্রতিকার নেই, তাই O রক্তের বাচ্চাদের অভিভাবকদের তাদের ছোট বাচ্চাদের মশা থেকে রক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
মশার কামড় থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য অভিভাবদের নিম্নলিখিত বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত—
খেলাধুলার সময়, স্কুলে বা বাসায় থাকা অবস্থায় যতটুকু সম্ভব লম্বা জামা কাপড় পরানো, যাতে মশা কামড়ানোর ঝুঁকি কম থাকে। সাদা বা কম উজ্জ্বল কাপড়ের প্রতি মশা আকৃষ্ট হয় কম। তাই বাচ্চাদের উজ্জ্বল রঙের কাপড় কম পরানো উচিত।
নিয়মিত বাচ্চাদের নখ কাটুন যাতে মশা কামড়ালে শক্ত করে আঁচড়াতে না পারে।
মশা কামড়ানো থেকে রক্ষা করার কিছু ক্রিম, স্প্রে, লোশন বাজারে পাওয়া যায়। মশা প্রতিরোধী উপাদানগুলো দুই ঘণ্টা পর্যন্ত মশার কামড় থেকে রক্ষা করে। তবে এগুলো ব্যবহার করার পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
ঘুমানোর সময় মশা থেকে বাঁচতে মশারির নিচে ঘুমানো প্রয়োজন। একই সময়ে, পরিবারগুলোর মশা নিধনের জন্য মশা নিরোধক স্প্রে, মশা নিরোধক ক্রিম, মশা নিধনকারী বৈদ্যুতিক র্যাকেট ব্যবহার করা উচিত। পরিবারের কোনো সদস্য ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে অবশ্যই মশারির নিচে রাখতে হবে যাতে পরিবারের অন্য কেউ তার মাধ্যমে আক্রান্ত না হয়।
বাচ্চাদের ডেঙ্গু জ্বর বা মশার দ্বারা সৃষ্ট অন্যান্য বিপজ্জনক সংক্রামক রোগের সংক্রমণ এড়াতে অভিভাবকদের শিশুদের জন্য মশার কামড়ের ঝুঁকির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মশা থেকে আপনার শিশুকে বা নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য আপনার বাড়ি বা বাড়ির আঙিনায় মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা অন্যতম উপায়।
যদি শিশুর ডেঙ্গু জ্বর বা মশার কামড়ের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য রোগের সন্দেহ হয়, তাহলে শিশুর অবস্থা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য অভিভাবকদের শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com